অণুকথন (মাত্রাবিন্যাস: ৫-৭-৫-৭): বাংলা সাহিত্যের এক নবধারার সূচনা
 |
অণুকথন কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ |
কবিতা সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়, জন্ম নেয় নতুন নতুন ধারা। ‘অণুকথন’ ৫-৭-৫-৭ মাত্রাবিন্যাসে রচিত এমনই এক নতুন কবিতা-শৈলী, যা সংক্ষিপ্ত এবং গভীর ব্যঞ্জনাময় প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি কবি নাজমুল আহসান মুছলিমীর সৃষ্ট অণুকবিতা এবং তাঁর স্বকীয় উদ্ভাবন।
 |
Nazmul Ahsan Muslimi নাজমুল আহসান মুছলিমী |
অণুকথনের পরিচিতি:
‘অণুকথন’ হলো সংক্ষিপ্ত, ভাবগভীর ও ব্যঞ্জনাময় কবিতা, যেখানে অল্প শব্দের মধ্যেই তীব্র অনুভূতি, সুখ-দুখ, প্রেম-প্রীতি-প্রণয়সহ যাপিত জীবনের সকল বিষয়াবলি প্রকাশ পায়। এটি হাইকুর মতো অণুকবিতা হলেও নিজস্ব গঠন ও মাত্রাবিন্যাসের কারণে স্বতন্ত্র।
হাইকু মূলত ৫-৭-৫ মাত্রাবিন্যাসে রচিত তিন লাইনের অণুকবিতা। আর তানকা ৫-৭-৫-৭-৭ মাত্রাবিন্যাসে রচিত পাঁচ লাইনের অণুকবিতা। এই দুই ধরণের কবিতাই জাপানি সাহিত্য থেকে উদ্ভূত এবং বহুল প্রচলিত।
অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যে অন্ত্যমিলসম্পন্ন (rhymed) ও শ্রুতিমধুর প্রচুর অণুকবিতা থাকলেও জাপানি হাইকু বা তানকার ন্যায় সুনির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাসে বিন্যস্ত কোনো অণুকবিতা ছিল না। বাংলা সাহিত্যের এই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যেই কবি নাজমুল আহসান মুছলিমী বাংলা ঘরানা এবং বাংলা ভাষার ছন্দরীতি অর্থাৎ মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ও স্বরবৃত্ত ছন্দ/শ্বাসাঘাতে (সিলেবল) ৫-৭-৫-৭ মাত্রাবিন্যাসে বিন্যস্ত চার লাইনের অণুকবিতা ‘অণুকথন’ সৃষ্টি করেছেন। এবং “অণুকথন কাব্যগ্রন্থ” নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন (ISBN: 978-984-98674-2-5)। বইটি নৃ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি ‘অণুকথন’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং স্বরচিত প্রায় পাঁচ শতাধিক ‘অণুকথন’ প্রকাশ করেছেন।
অণুকথনের বৈশিষ্ট্য, গঠন ও মাত্রাবিন্যাস:
- ৫-৭-৫-৭ মাত্রাবিন্যাস: এটি অণুকথনের অবিচ্ছেদ্য ও আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য। অণুকথন সর্বদা চার পঙ্ক্তিতে লেখা হয় এবং প্রতিটি পঙ্ক্তির মাত্রা ৫-৭-৫-৭ অনুযায়ী বিন্যস্ত থাকে। এই সুনির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাস (৫-৭-৫-৭) ব্যতীত কোনো কবিতাকে ‘অণুকথন’ বলা যাবে না।
- কাঠামোগত শৃঙ্খলা: মাত্রাবিন্যাস মেনে কবিতার ছন্দ ও গীতিময়তা বজায় থাকে।
- শব্দের মিতব্যয়িতা: অল্প শব্দে মাত্র চারটি লাইনেই সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা হয়।
- ইঙ্গিতপূর্ণতা: সরাসরি বর্ণনার পাশাপাশি নির্দেশনামূলক ও ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ উপস্থাপন।
- জীবনঘনিষ্ঠতা ও বহুমাত্রিকতা: সহজ শব্দে গভীর দর্শন, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটে।
“অণুকথন কাব্যগ্রন্থ”- এর কয়েকটি শ্রুতিমধুর ‘অণুকথন’:
(মাত্রাবৃত্ত ছন্দ: ৫-৭-৫-৭)
চিত্রকর;
চিত্রণে চিত্র।
চিত্রানুগে,
চিত্রে চিত্রিত।
(অক্ষরবৃত্ত ছন্দ: ৫-৭-৫-৭)
চিত্তের চিত্র;
চিত্রীর চিত্রপটে।
চিত্রে-বিচিত্রে,
চিত্রণে চিত্রকর।
(স্বরবৃত্ত ছন্দ/শ্বাসাঘাত/সিলেবল: ৫-৭-৫-৭)
চিত্রকের চিত্রণ,
চিত্রপটে চিত্রিত।
চিত্রানুগ চিত্রে,
চিত্রলে চিত্রায়িত।
অণুকথনের সাহিত্যিক গুরুত্ব:
- বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন: বাংলা সাহিত্যের ছন্দরীতি (মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত ছন্দ/শ্বাসাঘাত/সিলেবল) অনুসরণ করে সুবিন্যস্ত ও সুনির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাসে (৫-৭-৫-৭) রচিত নতুন ধারার ক্ষুদ্র কবিতা। যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
- বিশ্বসাহিত্যে ‘অণুকথন’: বিশ্বসাহিত্য বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি ভাষার সাহিত্য তার নিজস্ব ছন্দরীতি অনুসরণ করে। ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য মাত্রার পরিবর্তে সিলেবল (syllable) ব্যবহার করে কাব্যরচনা করে থাকে। বিশ্বসাহিত্যের অংশ হিসেবে অণুকথনও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত ছন্দ/ শ্বাসাঘাতের পাশাপাশি সিলেবলেও (syllable) রচনা করা যায়।
- সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য আকর্ষণীয়: ব্যস্তময় বর্তমান সময়ে পাঠকগণ বৃহৎ কবিতার চেয়ে অণুকবিতা পাঠেই অধিক স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। এছাড়াও ‘অণুকথন’ ছোট হওয়ার পাশাপাশি গভীর ভাবসম্পন্ন হওয়ায় পাঠকদের জন্য গভীর অনুভূতি ও নতুন অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
- শিক্ষণীয় ও অনুশীলনযোগ্য: সুবিন্যস্ত ও সুনির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাসে (৫-৭-৫-৭) রচিত হওয়ায় ‘অণুকথন’ নতুন লেখকদের জন্য শব্দব্যবহার ও সংক্ষিপ্ত প্রকাশশৈলীর চর্চার উত্তম মাধ্যম।
বিশিষ্ট কবিগণের চোখে ‘অণুকথন’:
কবি নাজমুল আহসান মুছলিমী ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ হতে বাংলা ছন্দরীতি অনুসরণ করে ৫-৭-৫-৭ মাত্রাবিন্যাসে ‘অণুকথন’ রচনা করছেন এবং সেই সম্পর্কে নিয়মিত ফেসবুকে লেখালেখিও করছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবিগণ ও পাঠকগণের নিকট ‘অণুকথন’ সুপরিচিতি লাভ করেছে ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাঁরাও নিয়মিত বিভিন্ন প্লাটফর্মে ‘অণুকথন’ নিয়ে লেখালেখি করছেন।
তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারার কবিতা 'অণুকথন' সম্পর্কে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, যিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে আলোকিত করেছেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ মহোদয়ের মতামত ও আলোচনা “অণুকথন কাব্যগ্রন্থ”-এ (২০ নম্বর পৃষ্ঠায়) যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে তিনি অণুকথনের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশের পাশাপাশি এই নতুন ও নিরীক্ষাধর্মী কাব্যধারা সৃষ্টি করার জন্য কবি নাজমুল আহসান মুছলিমীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সেইসাথে ‘অণুকথন’ সম্পর্কে কবি ড. সাঈফ ফাতেউর রহমান ও ভারতের বিশিষ্ট কবি ড. অনুপ কুমার দত্তের আলোচনাও অণুকথন কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ করা হয়েছে।
 |
কবি নির্মলেন্দু গুণের সাহিত্যদৃষ্টিতে অণুকথনের স্বতন্ত্রতা |
 |
ঢাকায় নিজ বাসভবনে অণুকথন কাব্যগ্রন্থটি পড়ছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, তাঁর পাশে বসে আছেন কবি নাজমুল আহসান মুছলিমী |
সারসংক্ষেপ:
‘অণুকথন’ একটি সম্পূর্ণ নতুন কবিতা-শৈলী, যা বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কবি নাজমুল আহসান মুছলিমীর উদ্ভাবিত এই কবিতা-ধারা ৫-৭-৫-৭ মাত্রাবিন্যাসে বিন্যস্ত, যা এর স্বতন্ত্রতা নিশ্চিত করে এবং একে অন্যান্য সংক্ষিপ্ত কবিতা বা অণুকবিতা থেকে আলাদা করে তোলে।
-Written by Safwan Ibn Shahab